Krishi Sampad
About this text
Introductory notes
Krishi Sampad was a monthly journal published from the city of Dhaka (now in Bangladesh). The journal focused on news and practices pertaining to agriculture and farming. The Journal was edited by Nishikanta Ghosh. The present volume of the journal was published in 1911. The selected aritcle, "Rajputanar Krishi o Krishak" was authored by Sir Jadunath Sarkar. Sir Jadunath, born in 1870, was a noted Indian historian. Sarkar is remembered for his works on Mughal and Maratha history, which demonstrated his grasp over Persian and Marathi sources. Sir Jadunath served briefly as the Vice-Chancellor of Calcutta University. He was knighted for his services in 1929.
The selections from this issue of Krishi Sampad have been made from the article of "Rajputanar Krishi o Krishak" ie "Farming practices and Farmers of Rajputana". The province of Rajaputana presently falls within the state of Rajasthan. The articles mention the challenges faced by the farmers of Rajputana owing to the regions arid climate. The articles highlights on the innovative methods of storing water adopted by the farmers of Rajputana. The article also suggests to how was not looked down upon and people of all class and strata took part in the farming process.
Selection details
The selections from this issue of Krishi Sampad have been made from the article of "Rajputanar Krishi o Krishak" ie "Farming practices and Farmers of Rajputana". The province of Rajaputana presently falls within the state of Rajasthan. The articles mention the challenges faced by the farmers of Rajputana owing to the regions arid climate. The articles highlights on the innovative methods of storing water adopted by the farmers of Rajputana. The article also suggests to how was not looked down upon and people of all class and strata took part in the farming process.
1. রাজপুতানার কৃষি ও কৃষক
জাপান প্রত্যাগত শ্রীযুক্ত যদুনাথ সরকার এম।এ।এস মহাশয়ের লিখিত ।
রাজস্থানের ইতিহাস পাঠে অথবা বচন পরম্পরায়, বীরপ্রসবিণী রাজপুতানার অতীত গৌরব-কাহিনী অনেকেই অল্প্যাধিক অবগত আছে । কিন্তু রাজপুতানার কৃষি ও কৃষকের বিষয়, আমার মনে হয়, বঙ্গের অত্যাল্প সংখ্যক লোকেরই অবগত হইবার সুযোগ ও সুবিধা ঘটিয়াছে । এই জন্যই, রাজপুতানার কৃষি ও কৃষক সম্বন্ধে, সংক্ষিপ্ত ভাবে দু'একটী কথা আলোচিত হইল ।
বাঙ্গালা দেশের প্রাকৃতিক অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, যেন প্রকৃতিদেবী, দরিদ্র কৃষকদিগের প্রতি অনুকম্পাপরবশ হইয়া, নিয়তই তাহাদের সর্ব্বাঙ্গীন, সাহায্যে তৎপরা রহিয়াছেন । কিন্তু রাজপুতানায়, ইহার বিপরীত বলিয়াই মনে হয়। তথায়, কৃষকদিগকে নিরন্তর প্রকৃতিদেবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়া, জীবিকার সংস্থান করিতে হয় । উর্ব্বর ভূমি, অনুকূল জল-বায়ু ও উত্তাপ- এই তিনটিই কৃষি-কার্য্যে সাফাল্যলাভের মূলকারণ । রাজপুতানা প্রদেশে এ তিনটীরই অভাব । বঙ্গের তুলনায়, সমগ্র রাজপুতানাকে এক বিশাল মরুক্ষেত্র বলা যায় । বিকানীর, যোধপুর এবং যশল্মীর- এই রাজ্যত্রয় মরু প্রদেশের কেন্দ্রস্থানে অবস্থিত । প্রায় সমগ্র প্রদেশের মৃত্তিকাই অনুর্ব্বরা, কারণ উহাতে কঙ্কর ও বালিএর ভাগ অত্যন্ত অধিক । মরুসীমান্তে উদয়পুর, কিষণগড়, জয়পুর, ভরতপুর, জিন্দ, পাতিয়ালা এবং ভাওয়ালপুর স্টেটসমূহেও বালি এবং কঙ্করমিশ্রিত ভূমির পরিমাণ নিতান্ত কম নহে । কিন্তু উক্ত সীমান্তরাজ্যসমূহের স্থানে স্থানে বেশ ঊর্ব্বর ভূমিও দেখিতে পাওয়া যায় । মরুভূমির আবহাওয়াও কৃষি কার্য্যোপযোগী নহে । গ্রীষ্মকালে, তাপের পরিমাণ কোন কোন দিন ১২১ ডিগ্রি হইতেও দেখা যায় । তখন শস্য দূরের কথা, উত্তপ্ত "লু" বায়ু প্রবাহিত হওয়ায়, গাছ-পালার সমুদয় পত্র দুদিনেই শুস্ক হইয়া ঝড়িয়া পড়ে । পক্ষান্তরে শীতকালে, গ্রীষ্মকালেরই অনুরূপ শৈত্যাধিক্য ঘটিয়া থাকে । কোন কোন বৎসর এত বেশী শীত পড়ে যে, রবিশস্য দূরের কথা, ৪। বৎসরের নিম ও শীরিষ প্রভৃতি গাছগুলিও ৩। দিনের মধ্যে মরিয়া যায় । গত বৎসর শৈত্যাধিক্য বশতঃ, বহু যত্নে এবং অর্থব্যয়ে বর্দ্ধিত, হাজার হাজার বৃক্ষ দুই দিনেই মরিয়া গিয়াছিল । ইহার পূর্ব্বেও, শৈত্যাধিক্য বশতঃ, অনেক গাছের পূর্ব্বোক্তরূপ দশাই ঘটিয়াছিল । মৃত্তিকায় এবং বাতাসে জলীয়াংশ না থাকায়, মরুভূমির আবহাওয়ার এত সহজে পরিবর্ত্তন হইয়া থাকে যে, কৃষি, বন এবং উদ্যান বিভাগের কর্ম্মচারীদিগকে অনবরত প্রকৃতির সহিত যুদ্ধ করিয়া চলিতে হয় । কৃষি-কার্য্যে জল-প্রয়োগের ব্যাবস্থা, বিকানীর এবং যশল্মীর অঞ্চলে অনেকটা আকাশকুসুমবৎ বলিয়াই মনে হয় । গ্রীষ্মকালে, পানীয় জলের জন্য, কোন কোন গ্রামে হাহাকার উপস্থিত হয় । কএক বৎসর পূর্ব্বে, কোন কোন গ্রামে, প্রতি বৎসর অনেকেই জলাভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হইত । তখন জলের এতই অভাব হইয়াছিল যে, কোনও ক্রিয়াকাণ্ড উপলক্ষে, নিজ নিজ বাড়ী হইতে জল লইয়া নিমন্ত্রণে যোগদিতে অনুরোধ করা হইত ।
এ অঞ্চলে [Page 167] খাল, বিল, নদী-নালা অথবা পুকুর পর্যন্ত নাই । কূপের গভীরতা ৩৩০ ফুট । একমাত্র বর্ষাকালেই, সম্বৎসরের কৃষিকার্য্য সম্পন্ন হইয়া থাকে । বালি মৃত্তিকার উপযোগী শস্যসমূহ অতি সহজে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ ফলিতে দেখা যায় । এ অঞ্চলে, জুলাই মাসে বৃষ্টি আরম্ভ হয় । পূর্ব্বে প্রতি বৎসর ৪ ইঞ্চি হইতে প্রায় ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হইত । গত চারি বৎসর যাবৎ ১০ ইঞ্চি হইতে ১৮ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হওয়ায়, বিকানীর অঞ্চলের, কৃষির অবস্থা অনেকাংশেই উন্নত হইয়া উঠিয়াছে । কিন্তু এ বৎসর, বিকানীরের নিকটবর্ত্তী স্থানসমূহে এক ইঞ্চি বৃষ্টিপাতও হয় নাই । ফলে, কৃষিকার্য একেবারেই চলিতেছেনা । এ প্রদেশে জুলাই হইতে নবেম্বর পর্যন্তই, কৃষির পক্ষে প্রশস্ত সময় । বিকানীর, যোধপুর এবং যশল্মীর রাজ্যের প্রধান শস্যই বজ্রাধান এবং এ দেশীয় লোকের প্রধান খাদ্য । বজ্রা এক প্রকার মিলেট(millet) জাতীয় শস্য । বজ্রার রুটি অতি পুষ্টিকর । কিন্তু ইহা বাঙ্গালীর পক্ষে, সহজপাচ্য নহে । বজ্রার পর 'মোট' নামক এক প্রকার কলাইর নামই বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য । বিকানীর রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে, পূর্ব্বোক্তরূপ জলাভাব দৃষ্টি হয় না । সে প্রদেশের কিয়দ্দূর পর্যন্ত পঞ্জাব হইতে পয়ঃপ্রণালী কাটিয়া আনা হইয়াছে । ভবিষ্যতে দেড় শতাধিক মাইল দূরবর্ত্তী বিকানীর সহর পর্যন্ত ঐ পয়ঃপ্রণালী আনীত হইবে, এরূপ আশা করা যাইতে পারে । যে সকল জায়গায় জলের অভাব কিঞ্চিৎ কম, তথায় বজ্রা, গম, ছোলা, মুগ, তিল এবং সরিষা প্রভৃতি শস্য বিস্তর জন্মিয়া থাকে । বালু মাটিতে, একবার মাত্র লাঙ্গনের কর্ষণ করিয়া, বীজ বপন করিলেই, তাহাতে সুন্দররূপে শস্য জন্মে । বঙ্গের ন্যায়, রাজপুতানার কৃষকদিগের জমি বিভিন্ন জায়গায়ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিত্তায় বিভক্ত নহে । সর্ব্বত্রেই বিস্তৃত মাঠ পতিত পড়িয়া রহিয়াছে । যাহার যতটুকু ইচ্ছা, অবস্থানুযায়ী সে ততটুকু ভূমিই এক জায়গায় চাষের উপযোগী করিয়া লইতে পারে । রাজা অথবা তাহার অধীনস্থ জমিদারকে সামান্য কিছু খাজানা দিতে হয় । সাধারণতঃ, মরুভূমির চাষ-বাসের জন্য বাছিয়া লওয়া হয় । রাজপুতানায় এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে ৫।৬ মাইলের মধ্যে লোকের বসতি এবং চাষ আদৌ দৃষ্ট হয় না । চাষের জন্য যে জায়গাটুকু বাছিয়া লওয়া হয়, তাহার চারিদিকে প্রায় তিনফুট গভীর এবং দুই ফুট পরিসর পরিখা । খনন করা হয় । খোদিত মৃত্তিকা দ্বারা ক্ষেত্র বেষ্টন করিয়া, এক অনুচ্চ দেওয়াল প্রস্তুত করার প্রথা প্রায় সর্ব্বত্রই প্রচলিত আছে । পরিখা এবং অনুচ্চ দেওয়ালের জন্য শূকর, গরু, ঘোড়া প্রভৃতি কোন জন্তুই ক্ষেত্রের কোন অনিষ্ট করিতে পারে না । বিশেষতঃ পরিখায় কতক দিবসের জন্য বৃষ্টির জল সঞ্চিত থাকায়, জমিতে বহুদিন পর্যন্ত রসের অভাব অনুভূত হয় না । বালি মৃত্তিকা অতি সহজেই কর্ষিত হইয়া থাকে । ভূমি একাধিক বার লাঙ্গল চালাইবার প্রথা নাই । এ অঞ্চলে, গলিত পত্রে এবং গোবর সাররূপ ব্যবহৃত হইয়া থাকে । যাহারা সারের উদ্দেশ্য পত্র এবং গোবর সঞ্চিত করিয়া থাকে, তাহারা অনেকটা বিজ্ঞান-সম্মত উপায়েই পচাইয়া লয় । গর্ত্ত খনন করিয়া, তন্মধ্যেই গোবর কিম্বা পত্রাদি সঞ্চিত রাখা হয় । তদুপরিভাগ এক স্তর মৃত্তিকা দ্বারা ঢাকিয়া দেওয়ার প্রথা আছে । মৃত্তিকায় আবরণ থাকাতে এবং এ অঞ্চলে অধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত না হওয়ায়, সঞ্চিত সার রৌদ্রে শুকাইয়া অথবা বৃষ্টিতে ধুইয়া যাইতে পারে না । ফলে সারের বিশেষ উপাদানগুলির লোপ পাওয়ার সম্ভাবনা কম । সুন্দর ভাবে পচাইবার নিমিত্ত মৃত্তিকার আবরণের উপর সময় সময় গোমূত্র কিম্বা জল ছিটাইয়া দেওয়া হয় । জলের নিতান্ত অভাব; কাজেই বিস্তর ব্যয়সাপেক্ষ বলিয়াই, এপর্যন্ত সর্ব্বসাধারণের পক্ষে, কৃষির জন্য পয়ঃপ্রণালীর বন্দোবস্ত ঘটিয়া উঠে নাই । কেবল বিকানীর এবং তন্নিকটবর্ত্তী স্থানের [Page 168] কতকগুলি রাজ্যোদ্যানেই বৈদ্যুতিক মটর ষ্টীম ইঞ্জিন এবং পার্শিয়ান হুইলের সাহায্যে জল-প্রয়োগের ব্যবস্থা দেখিতে পাওয়া যায় ।
এ অঞ্চলের আবহাওয়ায়, মৃত্তিকার উপযোগী শস্য ব্যতীত অন্য কোন নূতন শস্যের চাষ-প্রবর্ত্তনেও, আমরা প্রয়াস পাইয়া থাকি । বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করিলে, দুই একটী নূতন শস্যোৎপাদনবিষয়ে কৃতকার্য হওয়া যায় । এ স্থানের উপযোগী শস্যের বীজ ভিন্ন প্রদেশ হইতে আনীত হইলে, তাহারে অনেক সময়েই, আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না । আমি কখন কখন কলিকাতা হইতে কোন কোন বীজ আনিয়া দেখিয়াছি যে, উহার কিয়দংশ একেবারেই অঙ্কুরিত হয় না । পক্ষান্তরে, কিয়ৎ পরিমাণ অঙ্কুরিত হইলেও, অত্যল্প সময়ের মধ্যেই, শুকাইয়া মরিয়া যায় । অথচ ঐ জাতীয় বীজ লাহোর, সাহারণপুর, কিম্বা বোম্বে অঞ্চল হইতে আনয়ন করিয়া বেশ কৃতকার্য হইয়াছি । ইহাতেই মনে হয়, এতদঞ্চলের বর্দ্ধিত শস্যবীজের পক্ষে, স্থানীয় আবহাওয়াই বিশেষ উপযোগী । মৃত্তিকা এবং বায়ুতে জলীয়ভাগ অত্যল্প বলিয়া সব্জী ও ফল প্রভৃতি যথোপযুক্তরূপে সত্ত্বর বর্দ্ধিত হয় না বটে । কিন্তু অতি সুস্বাদু হইয়া থাকে। এ অঞ্চলে তরমুজ আকারে গোয়ালন্দের তরমুজকে পরাস্ত করিতে না পারিলেও, মিষ্টিতে অনেক শ্রেষ্ঠ সন্দেহ নাই । বিকানীরের জনৈক জমিদার তরমুজ হইতে শর্করা সংগ্রহ করিবার নিমিত্ত, ক্ষুদ্রায়তনে এক কারখানা স্থাপন সম্বন্ধে সময় সম্য আলোচনা করিয়া থাকেন ।
বিকানীর হইতে প্রতি বৎসর লক্ষ লক্ষ টাকার উল(wool) ইংলণ্ডে প্রেরির হইয়া থাকে । সুবিস্তীর্ণ পতিত ময়দান মেঘ চরাইবার পক্ষে বিশেষ উপযোগী বলিয়াই, শত শত মেশ-ব্যবসায়ীকে এই লাভজনক ব্যবসায়ে নিয়োজিত দেখিতে পাওয়া যাই । অস্ট্রেলিয়ায় বৈজ্ঞানিক উপায়ে, উলের উন্নতিবিধান করা হয় । এখানেও, কেহ কেহ বৈজ্ঞানিক উপায়ে মেষরক্ষণ এবং উলমিল(wool-mill) স্থাপনের কল্পনা সময় সময় করেন বটে; কিন্তু এ পর্যন্ত তাহা কেহ কার্য্যে পরিণত করিতে সক্ষম হয় নাই । সাধারণতঃ উল চারি শ্রেনীতে বিভক্ত । তন্মধ্যে, এ অঞ্চলের আবহাওয়ায়, অযত্নে রক্ষিত মেষ হইতেও, দ্বিতীয় শ্রেনীর উল সংগৃহীত হইয়া থাকে ।
যে বৎসর বৃষ্টি হয়, সেই বার অকর্ষিত ভূমিতে বিস্তর ঘাস জন্মিয়া থাকে । এ অঞ্চলের গরু-ঘোড়া অতি বলিষ্ঠ । চল্লিশ বা পঞ্চাশ টাকা মূল্যের গাভী হইতেও দৈনিক ৮। ১০ সের দুগ্ধ প্রাপ্ত হওয়া যায় । এখানকার দুগ্ধ অতিশয় মিষ্টি । প্রথম শ্রেণীর উৎকৃষ্ট ঘৃত সময় সময় টাকায় 'পাকা'(৮০ তোলার ওজন) একসের পাওয়া যায় । এবার, দুর্ভিক্ষের বৎসর বলিয়াই, তিন পোয়ার বেশী পাওয়া যাই না
এঅঞ্চলে, গৃহপালিত পশুর মধ্যে উষ্ট্রই প্রধান । ইহাকে মরুযান বলা যাইতে পারে । বিকানীরে যেরূপ বলিষ্ঠ উট পাওয়া যাই, ভারতের আর কুত্রাপি তেমন পাওয়া যায় না । ভারতবর্ষের মধ্যে একমাত্র বিকানীরে রাজ্যের অধীনেই উষ্ট্রারোহী সৈন্যের দল আছে ।
মরুভূমির সীমান্ত প্রদেশে উদয়পুর, জয়পুর, ভরতপুর প্রভৃতি যে সমুদয় রাজ্য আছে তথায় ধান্য ব্যতীত ভারতের অধিকাংশ শস্যই জন্মিয়া থাকে । উক্ত স্থানে দুই একটী খাল বা নামা দেখিতেও পাওয়া যায় । পক্ষান্তরে কূপের গভীরতাও তত বেশী নহে । ভরতপুর এবং জয়পুর অঞ্চলে দেখিয়াছি যে, প্রত্যেক কৃষক তাহার নিজ জমির কোন এক স্থানে একটি কূপ খনন করিয়া, তাহা হইতে বলদের সাহায্যে আবশ্যক মত ক্ষেত্রে জল প্রয়োগ করিয়া থাকে । ভরতপুর ও জয়পুর প্রভৃতি সীমান্ত প্রদশে তুলাও জন্মিয়া থাকে । এই স্থানের কৃষি-কার্যের জন্য বিশেষ যত্ন ও অত্যধিক পরিশ্রম করিয়া থাকে । যাহারা বেহার প্রদেশের মাঠে কৃষকদিগকে কৃষি-কার্য্যে লিপ্ত দেখিয়াছেন, তাঁহারা জয়পুর অঞ্চলের কৃষকদিগের শ্রমসাধ্য কৃষি বিষয়ে অনেকাংশে ধারণা করিতে পারিবেন ।
রাজপুতানা প্রদেশের কৃষকদিগের সম্বন্ধে দু'একটী কথা বলিয়াই, এ প্রবন্ধের উপসংহার করিব । এস্থানের কৃষক সম্বন্ধীয় আলোচনায় বঙ্গীয় শিক্ষিত সমাজের অনেক জ্ঞাতব্য বিষয় আছে । বঙ্গের ন্যায়, এ প্রদেশে কৃষি নীচ বা ঘৃণিত কার্য বলিয়া বিবেচিত হয় না । কৃষি মালীদের জাতীয় ব্যবসায় হইলেও, যে কোন শ্রেণীর ব্যক্তিকে কৃষি-কার্য্যে নিয়োজিত দেখিতে পাওয়া যায় । মালী বলিতে বঙ্গের মালী বুঝিতে হইবে না । এখানে মালী অস্পৃশ্য জাতি নহে; তাহাদের ঘৃতপক্কখাদ্য ব্রাণ, ক্ষত্রিয় প্রভৃতি উচ্চশ্রেণীর যে কোন ব্যাক্তিই গ্রহণ করিয়া থাকে । এখানকার মালীদিগকে সামাজিক হিসাবে, পূর্ব্ববঙ্গের মালাকারদের অনুরূপ বলিয়াই মনে হয় । কিন্তু ইহাদিগের একাদশ দিবসেই শুচি এবং শ্রাদ্দ্ব-শান্তি হইয়া থাকে । শিক্ষিতব্যাক্তি জাতিগত ব্যবসায় ছাড়িয়া, কৃষি-কার্য্য অবলম্বন করিলেও, এতদঞ্চলে বিদ্যার অনুশীলন বড় কম- সমুদ্রে শিশির বিন্দুবৎ-বলিয়াই। আজ পর্যন্ত অধিকাংশ মালী কৃষি ব্যবসায়ী ।
মালী ব্যতীত, ব্রাণ ও ক্ষত্রিয় প্রভৃতি উচ্চশ্রেণীর কৃষকের সংখ্যাও নিতান্ত কম নহে । বৈশ্য অর্থাৎ মাড়োয়ারী বনিকগণ ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে, কলিকাতা, বোম্বে, মাদ্রাজ প্রভৃতি সহরেই অবস্থান করিয়া থাকে । অন্যান্য শ্রেণীর লোকের মধ্যে যাহারা 'একটু' লিখা-পড়া জানে, তাহারা কেরাণী এবং গোমস্তার কার্য্য করিয়া থাকে । এতদ্ব্যতীত, প্রায় সকলেই কৃষি কার্য্যে নিয়োজিত রহিয়াছে । রাজবংশের সহিত সংশ্লিষ্ট উচ্চশ্রেণীর রাজপুতগণও স্বহস্তে কৃষি-কার্য্য করিয়া থাকেন ; এমন কি, রাজা উপাধিকারী বিখ্যাত বংশের রাজপুতও স্বীয় অবস্থা শোচনীয় হইয়া পড়িলে স্বহস্তে কৃষি-কৃষি-কার্য্য করিতে লজ্জা বোধ করেন না । রাজা উপাধিকারী পক্ককেশ কোন এক সদ্বংশীয় বৃদ্ধ কৃষককে দেখিয়া, আমার প্রায়ই রাজর্ষি জনকের কথা মনে পড়িয়া থাকে ।
পক্ষান্তরে বঙ্গে আমারা 'ফরিঙ বাবু' সাজিয়া কৃষি-কথায় ভ্রু সঙ্কুচিত করিয়া থাকি । সমগ্র বঙ্গে, কৃষক বলিতে চাষা অর্থাৎ মহামূর্খ এবং আদব কায়দা বিহীন নীচশ্রেণীস্থ বলিয়া মনে করি । এই জন্যই চাষা কথা এ দেশের গালি হইয়া দাঁড়াইয়াছে ! এমন কি চাষার ছেলেকেও চাষা বলিলে গালি দেওয়া হয় ! যাহা হউক, সুখের বিষয় এই যে, কালের গতির সঙ্গে সঙ্গে, আমাদের অন্ধবিশ্বাস আংশিকরূপে বিদুরীত হইতে বসিয়াছে । আজকাল, নব্য-সম্প্রদায়ের মধ্যে কৃষি প্রতি ততটা ঘৃণার ভাব দেখা যায় না । অনেক শিক্ষিত নব্যযুবকও কৃষি-কার্য্যে মনোনিবেশ করিয়াছেন । অন্যের তাঁবেদারীতে থাকার পরিবর্ত্তে, কৃষিলব্ধ সামান্য আয়ে, পবিত্র ভাবে জীবন কাটাইতে আজাকাল অনেক শিক্ষিত যুবকই প্রয়াসী হইয়াছেন । দেশের এবং সমাজের পক্ষে, ইহা একটী শুভ লক্ষণ বলিতে হইবে । জগতের যাবতীয় সভ্যদেশ, এমন কি বঙ্গ ব্যতীত ভারতেরই অন্যান্য প্রদেশসমূহ দর্শন করিলে, কৃষির প্রতি আর কাহারও অবজ্ঞা থাকিতে পারে না। বিকানীর রাজের বাগানগুলিতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, রাজপুত প্রভৃতি উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুগণই মালীর কার্য করিতেছে । সৎপথে থাকিয়া যে যে উপায় জীবিকার্জ্জন করা যাইতে পারে, তন্মধ্যে, আমার মনে হয়, কৃষি-কার্য্য সর্ব্বশ্রেষ্ঠ । কারণ, ইহাতে মিথ্যা, জুয়াচুরি ও শঠতার দরকার হয় না এবং অন্যের সর্ব্বনাশের জন্যো সর্ব্বদা 'ফন্দী পাকাইয়া' বেড়াইতে হয় না । কৃষি-কার্য্যে যিনি যত অধিক পরিশ্রম করিবেন, তিনি ততই সুফল লাভে পুরস্কৃত হইবেন সন্দেহ নাই । রাজপুতানা অঞ্চলের প্রাকৃতিক অবস্থা কৃষির পক্ষে তত অনুকূল নহে বলিয়াই, কৃষকগণ স্বীয় স্বীয় উপজীবিকার উপযোগী শস্যোৎপাদন করিতে পারিলেই যথেষ্ট মনে করিয়া থাকে । বস্তুতঃ মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া একমাত্র রাজপুতনার কৃষকেরাই কৃষি করিয়া থাকে ।