Krishi Samachar
About this text
Introductory notes
Krishi Samachar was a monthly journal published from the city of Dhaka(now in Bangladesh). The journal focused on news and practices pertaining to agriculture and farming. The Journal was edited by Nishikanta Ghosh. The present volume of the journal was published in 1910, the issue number though is illegible
The selected article from the journal Krishi Samachar discusses the role of Khona's maxims on cultivation of paddy. Khona is a semi-historical astrologer believed to have been alive during the reign of King Vikramaditya. Popular legends suggest, Khona who was of Sinhalese origin was married to the son of Varaha, the court philosopher of Vikramaditya. Khona herself came to be known for her astrological maxims. Khona's maxims mostly concentrated on agrarian practices and architectural planning of houses. The maxims of Khona have provided guidelines for the rural population of Bengal particularly the cultivators for centuries. This article explore some of the maxims pertaining to paddy cultivation, well-known in Bengal and also in Orissa and Bihar.
Selection details
The selected article from the journal Krishi Samachar discusses the role of Khona's maxims on cultivation of paddy. Khona is a semi-historical astrologer believed to have been alive during the reign of King Vikramaditya. Popular legends suggest, Khona who was of Sinhalese origin was married to the son of Varaha, the court philosopher of Vikramaditya. Khona herself came to be known for her astrological maxims. Khona's maxims mostly concentrated on agrarian practices and architectural planning of houses. The maxims of Khona have provided guidelines for the rural population of Bengal particularly the cultivators for centuries. This article explore some of the maxims pertaining to paddy cultivation, well-known in Bengal and also in Orissa and Bihar.
1. ধানের চাষে খনা
ধানের চাষ সম্বন্ধে খনায় যে সকল বচন আমাদের দেশের কৃষকদিগের মধ্যে প্রচলিত আছে, নিম্নে তাহারই কতিপয় বচন উদ্ধৃত ও আলোচিত হইল ।
ক্ষেতের এক কোণে শস্য (ধান্য) হইলেও কৃষকের লাভ হয় । বাণিজ্যর সোণা অপেক্ষা, ক্ষেত্রের কিয়দংশ স্থানেও যদি প্রচুর পরিমাণে ধান্য জন্মে, তাহা হইলে তাহাই এদেশবাসীর পক্ষে বিশেষ মঙ্গলজনক হইবে ।
নিকটের লোনাজমি (উদ্ভিদের পুষ্টির জন্য লবণ আবশ্যক । মৃত্তিকায় লবণের অভাব হইলে শস্য ভালরূপে জন্মেনা- জন্মিলে নিস্তেজ ও রুগ্ন হইয়া পড়ে । পক্ষান্তরে, লবণের আধিক্য হইলেও শস্য জন্মে না । সুন্দরবন অঞ্চলের জঙ্গল পরিস্কার করিয়া, যে সকল ভূমি চাষের উপযুক্ত করা হইয়াছে, লবণের আধিক্যই সেই সকল ভূমির প্রধান শত্রু । এই সকল ভূমি ২। ৩ বৎসর পতিত রাখিলে, বৃষ্টির জলে ক্রমাগত বিধৌত হইয়া, লবণহীন হয় এবং তাহাতে ফসল জন্মে । পতিতাবস্থায় বর্ষার পূর্ব্বে এইরূপ জমি গভীররূপে চাষ করিয়া দিতে হয় । জমিতে লবণের ভাগ বেশী থাকিলে, তাহা সহজেই স্থির করা যায় । বৃষ্টি হইয়ে গেলে পর, যখন ভূমি শুষ্ক হইতে থাকে, তখন উহার উপরিভাগে যে শ্বেতবর্ণ পদার্থ দৃষ্টিগোচর হয়, তাহা লবণ ভিন্ন আর কিছুই নহে । লবণ্যক্ত জমির উপরিভাগে গ্রীষ্মকালেও লবণ দৃষ্ট হইয়া থাকে ।) অর্থাৎ খারাপ জমি দূরের ঊর্ব্বরাভূমি অপেক্ষাও ভাল কারণ, নিকটে জমি থাকিলে, কৃষকেরা সর্ব্বদা তাহা পর্য্যবেক্ষণ করিতে সুবিধা পায়; সুতরাং জমির ঊর্ব্বরতা সাধনে যত্নবান হওয়া সহজসাধ্য হয় । ধান্যের জমি দূরে থাকিলে, কৃষকেরা সেই জমিতে যথারীতি আঁচড়া দিতে ও [Page 19] বারম্বার নিড়াইতে পারেনা; ফলে শস্যও বড় কম হয় । এই জন্যই ধানচাষের জমি বেশী ঊর্ব্বরা না হইয়াও তাহা যদি বাড়ীর নিকটে হয়, তবে তাহাই কৃষকের পক্ষে মঙ্গলজনক ।
এসম্বন্ধে আরও দুইটী প্রবাদ আছে :-
বাড়ীর নিকটে চাষ করিবে, বিশেষতঃ ধান্যের জমি বাড়ীর কাছে হওয়া সর্ব্বথাই বাঞ্ছনীয় । কারণ দূরের জমিতে, আঁচড়া ও নিড়ির অভাবে ধান্যক্ষেত্রে আগাছা জন্মিয়া শস্যের বিশেষ ক্ষতি করিয়া থাকে । ধানের জমিতে যত খাটিতে পারা যায়, ততই ফসল লাভ হয়; কিন্তু জমি নিকটে না হইলে, তাহাতে কৃষকের বড় দৃষ্টি পড়েনা । এই জন্যই দূরের জমিতে যথোচিত শস্য জন্মেনা । ঘুজি(বেঁটে) গাইর ছা(বৎস) থাকিলে, তাহাই কিনিবে । বেঁটে গরু খায় কম; কিন্তু খাদ্যের অনুপাতে দুধ বেশী দেয় । বড় গরু দুধ বেশী হইলেও, তাহার খাদ্যের পরিমাণে এত বেশী যে, মূল্য ধরিয়া হিসাব করিলে, কৃষকের লাভের পরিবর্ত্তে ক্ষতিই হইয়া থাকে । ঘুজি গাইর সহিত বাড়ীর নিকটস্থ ধান্যক্ষেত্রের তুলনা করিবার তাৎপর্য্য এই যে, ঘুজি গাইর মত নিকটের জমি খারাপ হইলেও, তাহাতে কৃষকের লাভ বেশী । কারণ দূরের ঊর্ব্বরা জমিতে কৃষকেরা সর্ব্বদা খাটিতে পারেনা বলিয়া, জমির ঊর্ব্বরতা সত্ত্বেও তাহা সুফল প্রস্থ হয়না ।
যে ভূমিতে বৃষ্টির জল দাঁড়ায়না- ভূইর (ভূমির) জল ভূইতেই মারে (বসিয়া যায়)- সেই ভূমি এবং যে গরু ঘন পা ফেলে অর্থাৎ খুব 'তেজী গরু', উভয়েই সমান আদরণীয় । ভূমি সমতল না হইলে, উচ্চ অংশে হইতে জল (বৃষ্টির বা সেচার) গড়াইয়া নিম্ন অংশে চলিয়া আসে । জল নিম্নদিকে গড়াইয়া যাইবার সময়, ক্ষেত্রের সারাংশ ও ( যাহা দ্রব অবস্থায় থাকে) উহার সহিত ধৌত হইয়া নিম্নদিকে চলিয়া যায় । ইহাতে উচ্চাংশে রসের অভাব হয়; ফলতঃ উচ্চভূমি শুষ্ক এবং অনুর্ব্বর হইয়া থাকে । পক্ষান্তরে, নিম্ন অংশে অতিরিক্ত আর্দ্রতা বশতঃ, তাহাতে বায়ু ও উত্তাপের কার্য্য হইতে পারেনা । ফলে উদ্ভিদের পোষণোপযোগী খাদ্য যথেষ্ট পরিমাণে বর্ত্তমানে থাকা সত্ত্বেও জমি অনুর্ব্বরা হইয়া পড়ে । ক্ষেত্র সমতল হইলে, সকল স্থানেই সমপরিমাণে জল শোষিত ও রক্ষিত হয়- কোনও অংশের আর্দ্রতা বা শুষ্কতা বৃদ্ধি পাইতে এবং মৃত্তিকার সারাংশও স্থানান্তরে চলিয়া যাইতে পারেনা । এতদ্ব্যতীত বৃষ্টিজলের সহিত বায়ুমণ্ডল হইতে যে কার্ব্বণিক ও নাইট্রিক এসিড প্রভৃতি ক্ষেত্রে পতিত হয়, তাহা মৃত্তিকায়ই শোষিত হইয়া অবস্থান করিতে পারে । সকল ক্ষেত্রেই সমতল হওয়া আবশ্যক; বিশেষতঃ ধানের চাষ করিতে হইলে একথাটী বিশেষ ভাবে স্মরণ রাখা কর্ত্তব্য । সমতল জমির আরও একটী বিশেষ গুণ এই যে, ইহা আবশ্যকমত জলশোষণ ও উত্তাপ আকর্ষণ করিয়া, মৃত্তিকার ঊর্ব্বরতা স্থায়ী রাখিতে পারে । অসমতল জমিকে কাটিয়া ভরিয়া, সমতল করিয়া লইতে পারিলে, উহার ঊর্ব্বরতা বহুপরিমাণে বর্দ্ধিত হয়; বিশেষতঃ তাহাতে জল ও উত্তাপের অভাব দাঁড়াইতে পারেনা - বৃষ্টি পতিত, হইবামাত্রই তাহা সর্ব্বত্র বসিয়া যায় । এই জন্যই যে ভুইব জল ভুইতে মারে তাহাই ধান্যরোপণ বা বপনের পক্ষে প্রশস্ত বলিয়া নির্দ্দেশ করা হইয়াছে । মা ভাল অর্থাৎ সুস্থ ও সবল হইলে যেমন তাহার মেয়ে, (মায়ের সহিত মেয়ের সম্বন্ধ বেশী!) এবং মেয়ের বাওরে ভাই (অন্য পিতার ঔরসজাত সন্তান । সহোদর না হইলেও, তাহার সহিত মাতৃরক্তের নিকট সম্বন্ধ আছে ।) ভাল হয়; সেইরূপ জমির সহিত নিকট সম্বন্ধ থাকিলেও তাহা অনুর্ব্বর হইতে পারেনা । পক্ষান্তরে, ঘন পা ফেলে, এইরূপ গরুর অর্থাৎ তেজী গরুর, বাছুরও বেশ ভাল হয় ।
গাঁয়ের যে ধারে 'ধোয়াটে' জল বার সেই বারে ঘন পা (ধানগাছের ঘন ঝাড় হয়; এই ঝাড়কেই পা বলা হইয়াছে । ঘন পা বলিতে ধান্য ও 'তেজীগরু' উভয়কেই বুঝাইয়া থাকে ।) অর্থাৎ ধান্যরোপণে যা বপণ করা এবং তেজীগরু ক্রয় করাই কর্ত্তব্য । কারণ রুগ্ন ও দুর্ব্বল গরুর দ্বারা ভালরূপ কর্ষণ করা অসম্ভব; সুতরাং সুফলের আশা করাও বিড়ম্বনা মাত্র । মা ভাল হইলে যেমন তাহার ছা(সন্তান) ভাল হয়, সেইরূপ গড়ানে জমি ধান্যের পক্ষে প্রশস্ত বলিয়াই তাহাতে নিশ্চয় ভাল ফসল জন্মিবে ।
বৃষ্টি জলের সহিত গ্রামের আবর্জ্জনা, মৃত্তিকা ও মলমুত্রাদি ধৌত হইয়া যে জমিতে পতিত হয়, (জল নিম্ন দিকেই যায়; সুতরাং গ্রামের পার্শ্বের জমি, নিম্ন সেই পার্শ্ব দিয়াই জল গড়াইয়া যায় বলিয়া, উক্ত নিম্ন ভূমিগুলিকে গড়ানে জমি বলা হয় ।) তাহাতে বিনা সারেও উত্তমরূপে ধান্য জন্মিয়া থাকে । কারণ গ্রামের আবর্জ্জনা সর্ব্বোৎকৃষ্ট সার ।
মীরাট সহরের রাস্তার আবর্জ্জনারশি এবং অপরিষ্কৃত জল, পার্শ্বস্থ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ড্রেণের মধ্য দিয়া সহরের প্রধান প্রধান ড্রেণে পতিত হইত । এই বড় ড্রেণগুলি সহরের নিকটস্থ কর্ষিত ভূমির নিম্নদেশ দিয়া অদূরবর্ত্তী নদীতে মিলিত হইয়াছে । ড্রেণবাহী আবর্জ্জনারাশি যে আমাদের কোন উপকারে আসিতে পারে ১৮৯৫ সন পর্য্যন্ত ইহা কাহারও মনে উদিত হয় নাই । ঐ বৎসরই মীরাটের কালেক্টর সাহেব ভারত গর্বমেন্টের কৃষি বিষয়ক রাসায়নিক পন্ডিতের পরামর্শে জলমিশ্রিত ড্রেণের আবর্জ্জনা, ভূমির সাররূপে ব্যবহৃত হইতে পারে কিনা, তাহা পরীক্ষা করিবার জন্য সরকারী কৃষিক্ষেত্রে প্রেরণ করেন । পরীক্ষার ফল অতিশয় সন্তোষজনক হইয়াছিল । সরকারী কৃষিক্ষেত্রের নিকটবর্ত্তী কৃষকগণ অত্যাল্প সময়ের মধ্যেই এই সারের উপকারিতে উপলব্ধি করিতে সক্ষম হইয়াছিল । সম্প্রতি এই ড্রেণবাহী আবর্জ্জনাদি সাররূপে ব্যবহৃত হইতেছে । ড্রেণসার বিক্রয় করিয়া মীরাট মিউনিসিপালিটীর বার্ষিক প্রায় চারি সহস্র টাকা আয় বৃদ্ধি হইয়াছে । এই ড্রেণসারে ভূমির ঊর্ব্বরতা এত বর্দ্ধিত হয় যে, তাহাতে প্রতিবৎসর তিনটী শস্য জন্মিলেও জমির ঊর্ব্বরতা নষ্ট হয় না । মীরাটসহরে ড্রেণসার [...] জমিতে ভূট্টা, আলু এবং তামাক- পর্য্যায়ক্রমে এই তিনটী ফসল উৎপন্ন হইতেছে । কানপুর ফার্ম্মের সুপারিন্টেণ্ডেন্ট মহোদয় উক্ত ড্রেণসারপুষ্ট জমির উৎপন্ন ফসলের পরিমাণবৃদ্ধিতে বিশেষ সন্তোষপ্রকাশ করিয়াছিলেন । তাঁহার উক্তিতে প্রকাশ, মীরাট সহরের কৃষকেরা [...] জমি চাষ করিয়ে ড্রেণসার সাহায্যে ৩।৪ শত টাকা উপার্জ্জন করিতেছে । অনুসন্ধানে জানা গিয়াছে যে, পূর্ব্বে যে জমিতে যথারীতি সার প্রদান করিতে পঞ্চাশ হইতে একশত টাকা পর্য্যন্ত ব্যয়িত হইত, ড্রেণসার ব্যভার করাতে তাহাতে মাত্র বার টাকা ব্যয় হইতেছে । ড্রেণসার ব্যবহারে খরচ কম, অথচ দ্বিগুণ মাত্রায় ফসল লাভ হইয়া থাকে । অতিপ্রাচীন সময়ে "খনা" যাহা বলিয়া গিয়াছেন, আজকাল পাশ্চাত্য কৃষিবিজ্ঞানবিদগণের বহু গবেষণার ফলে তাহারই সত্যতা প্রমাণিত হইতেছে ।
চাষ করিবার পূর্ব্বে সমুদয় জমির চতুর্দ্দিকে বেড়া দেওয়া আবশ্যক । যে সকল উচ্চভূমি বর্ষায় জলমগ্ন হয় না, সেই সকল ভূমির চতুস্পার্শ্বস্থ আইলের মৃত্তিকা অন্ততঃ একহাত উচ্চ করিয়া দিতে হয় । ইহাতেই ক্ষেত্রে বেড়া দেওয়ার কার্য্য সাধিত হয়; বিশেষতঃ আইল উচ্চ হওয়াতে বৃষ্টির জল সহজে বাহির হইয়া অন্যত্র চলিয়া যাইতে পারে না- ক্ষেত্রের জল ক্ষেত্রেই বসিয়া যায় । ফলে ভূমি নীরস হইতে পারে না, ধান্যও বেশ জন্মে । উত্তরবঙ্গের কৃষকেরা এই উপায় অবলম্বন করাতেই যথোচিত ধান্যলাভে নিরাশ হয় না ।
জলমগ্ন স্থানে, বন্যার সময় প্রবল স্রোতোবেগে ধান গাছ ছিন্নভিন্ন এবং সমূলে উৎপাটিত হইয়া ভাসিয়া যায় । ইহাতে মুহূর্ত্ত মধ্যেই শত শত কৃষকের সর্ব্বনাশ উপস্থাপিত হয় । নদীতীরস্থ এবং বিলের অভ্যন্তরস্থ ধান গাছ প্রবল স্রোতের হস্ত হইতে রক্ষা করিবার জন্য পূর্ব্ববঙ্গের কৃষকেরা জল প্রবেশের পথে ও ক্ষেত্রের স্থানে [Page 21] স্থানে ধঞ্চের আটি ফেলিয়া রাখে । ইহাকে "রেস" দেওয়া কহে । অনেক সময়ে ধঞ্চের "রেস" দিয়া শস্য রক্ষাকরা যায় । ধঞ্চের বেড়া দিলেও প্রবল স্রোতের হস্ত হইতে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে শস্য রক্ষাকরা যাইতে পারে । ধান্যক্ষেত্রে ধঞ্চের বেড়া দেওয়ার প্রথা আজ কালও পূর্ব্ববঙ্গ ও আসামের নানাস্থানে প্রচলিত আছে । গৃহপালিত পশুর হস্ত হইতে ধান্যরক্ষা করিবার জন্যো বেড়া দেওয়া আবশ্যক । পূর্ব্বোক্ত কোনও কারণে ধান্য না জন্মিলে, কৃষকের খাদ্যের অভাব ঘটিবে বলিয়াই ভূমিকর্ষণ করিবার পূর্ব্বেই বেড়া দেওয়ার বিষয় উল্লিখিত হইয়াছে ।
জমির চারিধারে 'আলি' দিয়া (চারিধারের আইল, মাটি দিয়া উচ্চ করিয়া দেওয়াকে 'আল' দেওয়া কহে । এমন ভাবে আল বাঁধিতে হইবে যে, তন্মধ্য দিয়া সহজে জল বাহির হইয়া যাইতে না পারে।) তাহার মধ্যে শালি (হৈমন্তিক) ধান্য রোপণ করিবে । শালি ধান্যে; যথেষ্ট পরিমাণ জলের প্রয়োজন হয় । আলি না বাঁধিলে, এই প্রয়োজন সম্যকরূপে সুসিদ্ধ হইতে পারে না বলিয়াই, শালি ধান্য রোপণ করিবার পূর্ব্বেই আলি বাঁধিবার ব্যবস্থা রহিয়াছে । উড়িষ্যায়ও এই সম্বন্ধে দুইটী প্রবাদ আছে । ইহাও খনার বচন বলিয়াই, এস্থলে উদ্ধৃত হইল ।
একহাত উচ্চ ও একহাত প্রস্থ করিয়া, ঘাসদিয়া বাঁধ বাঁধিয়া জল আটকাইবে; কারণ, তাহা হইলে ঐ জমিতে অধিক পরিমাণে ধান্য জন্মিবে ।
ভালরূপে আইল বাঁধিয়া বৃষ্টির জল 'আটকাইয়া' রাখিতে হইবে । কারণ, ক্ষেত্রের জল বাহির হইয়া গেলে ধান্য জন্মিবে না ।
যেমন শুদ্ধ উপবাস করিলেই ধর্ম্ম হয় না, সেইরূপ কেবল কোদাল পাড়লেই ('কোবাইলেই') চাষ হয় না । কারণ ধান্যের জমি বারম্বার কর্ষণ করা আবশ্যক ।
উল্লিখিত বচন হইতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হইবে যে, এক বার কোদাল দিয়া 'কোবাইলেই' জমি ধান্য চাষের উপযুক্ত হয় না । যে জমিতে ধান্য রোপণ করিতে হইবে , তাহাতে অন্ততঃ চারিবার হালচাষ করিতে হইবে ।
বিহারেও এসম্বন্ধে এই রূপ শুনা যায় ।-
এ সম্বন্ধে উড়িষ্যায় ও এইরূপ শুনা যায় :-
মূলার জমিতে ৬০ বার চাষ দিতে হইবে । তার অর্দ্ধেক (৩০ বার) ইক্ষু ক্ষেত্রে এবং তা'র অর্দ্ধেক অর্থাৎ ১৫ বার ধান্যক্ষেত্রে চাষ দিতে হইবে । এইরূপ করিতে পারিলেই কৃষকের সুফল লাভের জন্য ভাবিতে হইবে না; সুতরাং [Page 22] সে মনের আনন্দে পান খাইতে পারিবে । উৎকলবাসীরা স্বভাবতঃই তাম্বুলপ্রিয় । তাহাদের চিরসঙ্গী 'বটুয়া'ই (কাপড়ের থলিয়াবিশেষ-ইহাতে পান, সুপারি, চূণ এবং ছোট একখানা 'সরতা' প্রভৃতি থাকে।) তাহার নিদর্শন । ধান্যের উৎপত্তি বৃষ্টির জলের উপরই সম্পূর্ণ নির্ভর করিয়া থাকে । যথাসময়ে এবং যথোপযুক্ত পরিমাণে বৃষ্টি না হইলে ধান্য জন্মে না; ফলে , কৃষকের সর্ব্বনাশ হয় । কোন সময়ে কিরূপ বৃষ্টি হওয়া আবশ্যক, সে সম্বন্ধে খনার বচন এইরূপ :-
আষাঢ় মাসের বৃষ্টি ক্ষেত্রে জল দাঁড়াইবেনা- বৃষ্টির জল ক্ষেত্রেই শোষিত হইয়া যাইবে । আষাঢ় মাসের বৃষ্টির জলের সহিত ধুলির সম্বন্ধে থাকিবে অর্থাৎ এমন ভাবে বৃষ্টি হইবে, যাহা ধুলি শোষণ করিয়া ফেলিতে পারে । শ্রাবণ-মাসের বৃষ্টিতে ক্ষেত্রে পালি (গ্লাশ) পরিমিত অর্থাৎ সামান্য জল দাঁড়াইবে এবং সেই জল শুকাইবে না শুকাইতেই পুনরায় বৃষ্টি হইবে; এসময়ে ক্ষেত্রে সামান্য পরিমাণ জল থাকা আবশ্যক । সিংহে (ভাদ্রমাসে) শুখা (অনাবৃষ্টি) হইবে; কারণ এ সময় বৃষ্টি হইলে, কেবল শীষ হয়, ধান হয় না । কন্যায় (আশ্বিন মাসে) প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হইয়া ক্ষেত্র জলমগ্ন হইবে । তুলায় (কার্ত্তিক মাসে) বিনা বায়ুতে অর্থাৎ ঝড় না হইয়া (এ সময়, ঝড় হইলে, ধান্যের বিশেষ ক্ষতি হয়। কারণ, কার্ত্তিকমাসে ধানগাছে শীষ হয়, তখন ঝড় হইলে, গাছের গোড়া শিখিল হইয়া পড়ে; ফলে ধানে 'চিটা' জন্মে। ) দুই এক পশলা বৃষ্টি হইবে, এইরূপ ভাবে বৃষ্টি হইলেই, প্রচুর ধান্য জন্মিবে । প্রভৃতি সকল বৎসর কৃষকদিগের এত আবদার রক্ষা করেন না বলিয়াই সকল বৎসর ধানের আবাদ সুবিধামত সম্পন্ন হয় না ।
আষাঢ়মাসে বৃষ্টি হইলে জমি চাষের যোগ্য হয় । কৃষকেরা সেই সময়ে চাষের কার্য্য একরূপ শেষ করিয়া থাকে; সুতরাং আষাঢ়ের বৃষ্টি নামমাত্র । শ্রাবণমাসে বৃষ্টি হইলে অধিক ধান্য জন্মে । ভাদ্রমসে বৃষ্টি হইলে, কেবল শীষহয়, ধান হয়না । আশ্বিনমাসে বৃষ্টি হইলে, ধান ভালরূপে জন্মেনা ।
অগ্রহায়ণ ও পৌষমাসে পাকা ও কাটা ধানের উপর অধিক বৃষ্টি হইলে, অত্যন্ত ক্ষতি হইয় । পাকাধানে বৃষ্টি পতিত হইলে, 'ছড়া' হইতে সমুদয় ধান্য ঝড়িয়া পড়িয়া যায়; সুতরাং কৃষকের ভাগ্যে ধান্যলাভ মোটেই হয় না । ফলে তুঁষে ও কড়ি (অর্থলাভ) হয় । ধান্য না জন্মিলে, প্রজারা খাজনা দিতে অসমর্থ হয়; কিন্তু প্রজার নিকট হইতে খাজনা পাইলে রাজার চলেনা, তাই তাঁহাকে প্রজার বাড়ী বাড়ী মাগনে (ভিক্ষা করিতে) যাইতে হয় । ইহার তাৎপর্্য্যা এই যে, ধান চাউল, অত্যন্ত মহার্ঘ্য হইয়া উঠে ।
আষাঢ় মাসে ধানগাছ রোপণ করিলে, উত্তম শস্য হয় । শ্রাবণমাসে রোপণ করিলে, দল(গাছের পাতা) বেশী হয় ভাদ্রমাসে ধানে শস্য হয়না, কেবল তুঁষ হয় ও আশ্বিনমাসে কিছুই হয় না । "রোয়াধান" আষাঢ়মাসে রোপণ করাই প্রশস্ত ।
বৈশাখ মাসে ধান বুনিলে ও আষাঢ় মাসে ধানরোপণ করিলে, এত ধান হয় যে, তাহা রাখিবার স্থান হয় না অর্থাৎ প্রচুর পরিমাণে ধান্য জন্মে ।
আষাঢ় মাসের ৫ই তারিখের মধ্যে (প্রথম ভাগে) ধান্যে রোপণ করিলে, প্রাপ্ত ধান্যে কৃষকের সুখ ও সম্মান বর্দ্ধিত [Page 23] হইতে পারে । ইহার তাৎপর্য এই যে, যথেষ্ট পরিমাণে ধান্য জন্মে । প্রচুর পরিমাণে ধান্য জন্মিলেই সম্বৎসর কৃষকের পরম সুখেই অতিবাহিত হয়; বিশেষতঃ রাজার খাজানা দিতে ও আত্মীয় স্বজন অতিথি ও অভ্যাগতদিগকে সন্তোষপূর্ব্বক ভোজন করাইতে পারে বলিয়া, তাহাদের সম্মান ও বর্দ্ধিত হয় ।
আলি জমি (যে নির্দ্দিষ্ট স্থানে বীজ হইতে চারা উৎপন্ন করিয়া, ক্ষেত্রে লাগান হয়, তাহাকে পূর্ব্ববঙ্গে "আলিজমি" কহে । স্থানবিশেষে ইহাকে "ভাটী" বা "হাপর" ও কহিয়া থাকে ।) হইতে চারা তুলিয়া লইয়া, তাহা শ্রাবণমাস হইতে ভাদ্রমাসের ১২ই পর্য্যন্ত রোপণ করিতে হইবে ।
বিহারে এ সম্বন্ধে তিনটী প্রবাদ আছে ।-
অরদরা অর্থাৎ আর্দ্রাতে (আষাঢ়ের প্রথম ভাগে- ১০ই হইতে ২১ শে আষাঢ় পর্য্যন্ত) ধান্য বপ্ন করিলে, প্রচুর পরিমাণে জন্মে ।
পুনরবস অর্থাৎ পুনর্ব্বসুতে (আষাঢ়ের ২২শে হইতে ৪ঠা শ্রাবণ পর্য্যন্ত) বপন করিলে ধান্যশীর্ষে ফল ধরে না এবং পৈয়া অর্থাৎ পুষ্যাতে (শ্রাবণের প্রথম ভাগে- ৫ই হইতে ১৮ই শ্রাবণ পর্য্যন্ত) বপন করিলে কিছুই হয় না ।
উত্তরফল্গুনীতে (ভাদ্রমাসের শেষ ভাগে- ভাদ্রমাসের ২৮শে হইতে ১০ই আশ্বিন পর্য্যন্ত) ধান্যরোপণে তিনটি ধান হইলে, তেরটী পৈয়া- চিটা হইবে । ইহার তাৎপর্য্য এই যে, চিটার অংশ্যই বেশী হইবে অর্থাৎ ধান্য নাম মাত্র জন্মিবে ।
ভাদ্রমাসের কুসী অমাবস্যার পর (ভাদ্রমাসের অমাবস্যায় ব্রাহ্মণেরা মন্ত্রপাঠপুর্ব্বক 'কুশা' (কুশ) ঘাস মাটিতে রোপণ করে বলিয়াই, ইহাকে কুসী আমাবাস বা অমাবস্যা কহে ।) এবং চতুর্থীর চন্দ্র উদিত হইবার পর, হে কৃষক, তোমার ধান্যরোপণ করিবার কোন আবশ্যকতা নাই । ইহার তাৎপর্য্য এই যে, এই সময়ে ধান্যরোপণ করিলে, কিছুই জন্মিবে না ।
উড়িষ্যাতেও এইরূপ দুইটি প্রবাদ প্রচলিত আছে ।-
মিথুনে (আষাঢ়মাসে এক ছত্র পরিমিত স্থান ব্যবধানে , ককড়া অর্থাৎ কর্ক্কট, (শ্রাবণে) একহাত এবং সিংহে (ভাদ্রমাসে) চৌকা- অর্দ্ধহস্ত ব্যবধানে ধান্য রোপণ করিতে হইবে । ইহার পরে ধান্য রোপণ করিলে, তাহা বলদের খাদ্য হইবে, অর্থাৎ কিছুই জন্মিবে না ।
ফাল্গুণ মাসে ধানের জমি চাষ করিলে সোণা পাওয়া যায়; চৈত্রমাসে চাষ করিলে, কুটুম্ব পোষণের উপযুক্ত; বৈশাখ মাসে জমিদারের খাজনা পরিশোধ করিবার মত এবং জ্যৈষ্ঠ মাসে বেতনভোগী কৃষাণদের বেতন দিবার মত অর্থাৎ অতি সামান্য পরিমাণ ধান্য পাওয়া যায়; কিন্তু আষাঢ় মাসের প্রথমে জমি চাষ করিলে, বনে গমন করা বা আত্মহত্যা করাই শ্রেয় । ইহার তাৎপর্্য্যপ এই যে, "জো" মত চাষ করিতে না পারিলে, অসময়ে ধান্য রোপণ করিয়া, ফসলের আশাকরা দুরাশা মাত্র । ধান্য না জন্মিলে, স্বপরিবারের অনাহারজনিত মৃত্যুদর্শন অপেক্ষা বনে গমন বা আত্মহত্যা করাই শ্রেয় ।
ধানের ঝাড় যদি মোটা অথচ ফাঁক ফাঁক হয়, তাহা হইলে অধিক ধান্য জন্মে ।
এক অগ্রহায়ণ মাসের মধ্যেই ধান পাকিয়া উঠে ও তিন শ্রাবণ মাস অতীত হইলে পান উত্তম হয় ।
আশু বা আউশ ধান্য তিন মাসের মধ্যেই পাকিয়া উঠে । আশু(শীঘ্র) জন্মে বলিয়াই ধান্যের নাম আশু ধান্য হইয়াছে । আউশ শব্দ আশুরই অপভ্রংশ ।
যদি রাত্র দিন বৃষ্টি হয়, তাহা হইলে ষাটধান্য (আশুধান্য বিশেষ) ৬০দিনে পাকিয়া উঠে ।
ঊড়িষ্যায়ও এ সম্বন্ধে একটী প্রবাদ শুন যায় ।
হৈমন্তিক ধান্য তুলার (কার্ত্তিক মাসের) পূর্ব্বে পক্ক হয়না ।
কার্ত্তিক মাসের পূর্ব্বে যে, হৈমন্তিক ধান্য পরিপক্ক হয়না, এই বেদবাক্যের অনাথা হইতে পারেনা ।
ধানে 'থোর' হইবার ৩০ দিন, ফুলিবার ২০ দিন ও ঘোরা মুখে অর্থাৎ শীষ মত হইবার ১২ দিন পর ধান কাটিবার উপযুক্ত হয় । এসম্বন্ধে ঊড়িষ্যায় ও দুইটী প্রবাদ আছে ,-
কার্ত্তিক মাসে ধান অফুলা ও অগ্রহায়ণ মাসে অপচলা (অপক্ক থাকেনা ; সকল ধানই পাকিয়া উঠে ।)
পূর্ব্বে অথবা পরে যে সময়েই ধান্য বপন করনা কেন, গর্দ্ভনা সংক্রান্তির (আশ্বিন মাসের সংক্রান্তি) সময় সমুদয় ধান্যেই থোর হইবে ।
ঊড়িষ্যায় খনার বচন এইরূপ
সকল প্রকার ধান্যই "থোর" হইবার ৩০ দিন এবং ফুল ধরিবার ২২ দিন পরে পাকে । ধানে "থোড়" হইবার পর, তন্নিম্ন প্রদেশে ফুল ফোটে । এই ফুলের আকৃতি অতিশয় ক্ষুদ্র । বিশেষভাবে পর্য্যবেক্ষণ না করিলে, ফুল দৃষ্ট হয় না সত্য; কিন্তু উহার সুমিষ্ট তীব্র গন্ধ ক্ষেত্রের পার্শ্বে দাঁড়ালেই অনুভূত হইয়া থাকে । পাকিবার পূর্ব্বে ফুলটী ঝড়িয়া পড়ে; কিন্তু ফুলের মধ্যভাগস্থ সাদা ডাটটী বর্ত্তমান থাকে । ইহাই এ প্রদেশে ধানের 'সুঙ্গ' নামে কথিত হয় । শীষ দেখে বিশ দিন ।
যে দিন ধানের শীষ বাহির হয়, সেইদিন হইতে ২০ দিনের পর ধান কাটিবার যোগ্য হয় । উহা দশ দিনের মধ্যেই কাটা মারা শেষ করা উচিত ।
অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটিলে, ষোল আনা ধান পাওয়া যায়; পৌষমাসে তাহার অর্দ্ধেক পাওয়া যায় । মাঘমাসে কেবল নড়া(নাড়া বা খড়) পাওয়া যায়; কিন্তু ফাল্গুনমাসে কিছুই পাওয়া যায়না ।
এই বচনেও পৌষের মধ্যে ধান কাটিলে যে, দ্বিগুণ লাভ হইবে, তাহাই বলা হইয়াছে ।
ভাদ্রমাসে বৃষ্টির সময় ভূমিকম্প হইলে, রাজা ও গরু নষ্ট এবং অত্যন্ত বন্যা হয় । ফলে, মোটেই ধান হয় না- ভীষণ দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হয় ।
বর্ষাকালে দিনে রৌদ্র ও রাত্রিতে বৃষ্টি হইলে, ধানগাছ সতেজ হয় ।
কার্ত্তিকমাসের উনজলে অর্থাৎ সামান্য বৃষ্টিতে ধানগাছ সতেজ হয় ।
যে বৎসর তেঁতুল বেশী হয়, সে বৎসর ধান্য বেশী জন্মে । আম অধিক হইলে বন্যা হয় ।
বৈশাখ মাসের প্রথম ভাগে বৃষ্টি হইলে, আশু ধান্য অধিক জন্মে ।
জাওলা অর্থাৎ ধান্য যখন ছোট থাকে, তখন যদি বৃষ্টি না হইয়া, তাত অর্থাৎ রৌদ্র হয়, তাহা হইলে চাষারা মাতিয়া উঠে । তাহাদের মত্ততার কারণ এই যে, ধান্য বেশী জন্মিবে ।
ধানে রৌদ্রের ও পানে ছায়ার আবশ্যক হয় ।